এক জন গর্ভবতী মায়ের সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সঠিক সময়ে নির্ধারিত টিকা গুলো নেওয়া। কারণ গর্ভবতী মায়ের টিকা ক্ষতিকর সব সংক্রমণ থেকে রক্ষা করে। গর্ভাবস্থায় টিকা নিলে নিজে ও আপনার সন্তান উভয়েই ক্ষতিকর সংক্রমণ থেকে রক্ষা পাবে। গর্ভাবস্থায় টিকা নিলে মাকে যেমন দীর্ঘ সময় সুস্থ রাখবে ঠিক আপনার আদরের সন্তানটি জন্মের কয়েকমাস পরেও তার টিকা শুরু করার আগ পর্যন্ত নিরাপদ থাকবে। গর্ভবতী মায়েদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা আপনার গর্ভের সন্তানকে গুরুতর অসুস্থ থেকে রক্ষা করবে। মা ও শিশুর যন্তে টিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
মায়ের অসুস্থতা শিশুর বৃদ্ধি ও বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করে থাকে। যেমন গর্ভবতী মায়েদের রুবেলার ইনফেকশন হলে সন্তান জন্মগত কিছু
সমস্যা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে, এমনকি জন্ম গ্রহনের পূর্বেও সন্তানের মৃত্যু হতে পারে। রুবেলা আক্রান্ত মায়ের গর্ভে জন্ম নেওয়া শিশুর এই সমস্যা স্থায়ী। আক্রান্ত পরবর্তী সময়ে শিশুটির দুঃসহ যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়। তবে এটি নিয়ে চিন্তা না করে গর্ভবতী হওয়ার আগে রক্ত পরীক্ষা করে নিশ্চিত হতে হবে গর্ভবতী মায়ের রুবেলা প্রতিরোধের ক্ষমতা আছে কি না। আমাদের দেশে বেশির ভাগ নারীই নয় মাস বয়সেই হামের সঙ্গে রুবেলার টিকার প্রথম ডোজ নিয়ে থাকেন, আর দ্বিতীয় ডোজটি নিয়ে থাকেন ১৫ বছর বয়সে।যদি রুবেলা টিকা না নেওয়া থাকে, তাহলে দ্রুত টিকাটি নেওয়া ভালো । কিছু রোগ আছে, যা মায়ের গর্ভ থেকেই শিশুর শরীরে প্রবেশ করে থাকে।যেমন হেপাটাইটিস-বি,এইডস, হেপাটাইটিস-এ এমন কিছু রোগ। আমদের দেহে সংক্রমণ রোগ প্রতিরোধে টিকার ভূমিকা অনস্বীকার্য।অনেক সংক্রামক রোগ টিকার মাধ্যমে প্রতিরোধ করা সম্ভব। তবে আমাদের দেশে সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির মাধ্যমেশিশু ও গর্ভবতী মায়েদের টিকাদানের ব্যবস্থা চালু আছে। সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির আওতায় আমাদের দেশে সন্তান জন্মদানে সক্ষম নারীর বয়স ১৫ থকে ৪৯ বছর এদের ধনুষ্টংকার ও রুবেলার বিরুদ্ধে টিটি ও এমআর টিকা দেওয়া হয়।
টিটেনাস বা ডিপথেরিয়া বা পারটুসিস টিকা যে কোন সময়ই নেয়া যায়। তবে গর্ভবস্থায় ২৭-৩৬ মাসের মধ্যে এই টিকা নেয়াটাই উপযুক্ত সময়।
এই টিকা টক্সয়েড ধরনের বলে গর্ভাবস্থায় নেয়ার জন্য নিরাপদ। টিটেনাসকে লক’জ ও বলা হয়ে থাকে। এর জন্য কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র আক্রান্ত হয় এবং পেশীতে বেদনাদায়ক খিঁচুনি হয়। এই টিটেনাস সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়া মাটিতে এবং পশুর বর্জ্যে পাওয়া যায়। আমদের শরীরের ত্বকের কোন স্থানে কেটে গেলে এটি রক্তস্রোতে প্রবেশ করতে পারে।গর্ভাবস্থায় টিটেনাসে আক্রান্ত হলে গর্ভবতীর মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। শ্বসনতন্ত্রের সংক্রমণজনিত রোগ হচ্ছে ডিপথেরিয়া। ডিপথেরিয়া জন্য প্যারালাইসিস হওয়া, শ্বাসকষ্ট হওয়া,কোমায় চলে যাওয়া এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
আর পারটুসিস ব্যাকটেরিয়া ঘটিত চূড়ান্ত রকমের সংক্রামক রোগ। পারটুসিস ফলে ক্রমাগত ও গভীর কাশি হয় এবং উচ্চ শব্দ হয় বলে একে ‘হুপিংকাশি’ ও বলে।
ফ্লু এর টিকা গর্ভবতী মায়েদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কোন নারী গর্ভাবস্থার মধ্যবর্তী সময়ে ফ্লুতে আক্রান্ত হলে তীব্র উপসর্গ বা নিউমোনিয়ার মতো জটিল অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে। মধ্যম মানের ফ্লুতে আক্রান্ত হলেও মাথা ব্যথা,জ্বর, গলা ব্যথা পেশীর ব্যথা, ও কাশির মতো যন্ত্রণাদায়ক উপসর্গগুলো দেখা দেয়। তবে মার্কিন যুক্তরাস্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল (CCD) ফ্লু এর ঋতুতে অর্থাৎ নভেম্বর থেকে মার্চের সময়টাতে যে সকল নারীরা গর্ভবতী হবেন তাদেরকে ফ্লু শট অর্থাৎ ইনজেকশন নেয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকে। ফ্লু এর টিকা সাধারণত মৃত ভাইরাস দিয়ে তৈরি বলে মা ও গর্ভজাত সন্তান উভয়ের জন্যই নিরাপদ। কিন্তু লক্ষ্য রাখতে হবে ফ্লুমিস্ট এক ধরনের ন্যাজাল স্প্রে ভ্যাক্সিন যা জীবন্ত ভাইরাস দিয়ে তৈরি হয় বলে এটি অবশ্যই এড়িয়ে যেতে হবে প্রেগনেন্ট নারীদের।
CCD-এর মতে প্রত্যেক গর্ভবতী নারীরই হেপাটাইটিস বি শনাক্তকরণের পরীক্ষা করানো উচিত। এর কারণ অনেক সময় এই রোগটি তার উপস্থিতির জানান দেয় না। গর্ভাবস্থায় হেপাটাইটিস বি এর টিকা নেয়া অনেক নিরাপদ। আমরা জানি হেপাটাইটিস বি ভাইরাস জনিত সংক্রামক রোগ। এর ফলে বমি বমি ভাব, যকৃতের প্রদাহ, ক্লান্তি এবং জন্ডিস দেখা দিতে পারে। হেপাটাইটিস বি টিকানা দেয়া হলে দীর্ঘমেয়াদী লিভার ডিজিজ, লিভার ক্যান্সার এবং মৃত্যুও হতে পারে। গর্ভবতী নারী যদি হেপাটাইটিস বি-তে আক্রান্ত হোন তাহলে ডেলিভারির সময় এই ইনফেকশন নবজাতকের মধ্যে ছড়ানোর সম্ভবনা থাকে। চিকিৎসা সঠিক সময়ে করা না হলে শিশুর পূর্ণ বয়স্ক অবস্থায় মারাত্মক যকৃতের রোগ হওয়ার ঝুঁকিতে থাকে।
হেপাটাইটিস এ এর টিকা গর্ভবতী মাকে যকৃতের রোগের বিরুদ্ধে সুরক্ষা দেয়, এটি সাধারণত ছড়ায় সংক্রমিত পানি ও খাবারের মাধ্যমে। ক্লান্তি জ্বর,ও বমি বমি ভাবের মত লক্ষণগুলো দেখা দেয় এই রোগে আক্রান্ত হলে। তবে এটি হেপাটাইটিস বি এর মতো মারাত্মক কোন রোগ নয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই অসুস্থতা গর্ভজাত সন্তানের উপর কোন প্রভাব ফেলে না। হেপাটাইটিস এ প্রিম্যাচ্যুর লেবারের সৃষ্টি করতে পারে এবং নবজাতকের ইনফেকশনও হতে পারে।
গর্ভবতী মায়ের যদি দীর্ঘমেয়াদী কোন রোগ যেমন- ডায়াবেটিস অথবা কিডনি রোগ থাকে তাহলে চিকিৎসক আপনাকে নিউমোকক্কাল ভ্যাক্সিন নেয়ার পরামর্শ দেবেন। এটি কয়েক ধরনের নিউমোনিয়া থেকে সুরক্ষা দেবে। গর্ভজাত সন্তানের ক্ষতির বিষয়টি এখনও অজানা, তবে বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করেন যে ঝুঁকি কম। তাই গর্ভবতী মায়ের টিকা নেওয়া জরুরী।
টিটেনাস (ধনুষ্টংকার) থেকে রক্ষ পাওয়ার জন্য এই টিটি টিকা নিতে হয়। গর্ভবতী মায়েদের টিটি টিকা নিতে হবে যেন বাচ্চার ধনুষ্টংকার না হয়। এক্ষেত্রে যদি আগে কোনো টিকা নেওয়া না থাকে, তবে সবগুলোই দিতে হবে। শিশুদের আমরা যে পেন্টা ভ্যালেন্ট (pentavalent vaccines) টিকা দিয় তাতে ধনুষ্টংকার প্রতিরোধী টিকা থাকে। কিন্তু এই টিকা নবজাতককে সুরক্ষা দিতে পারে না বিধায় বর্তমানে সম্প্রসারিত টিকা দান কর্মসূচির আওতায় আমাদের দেশে সন্তান জন্মদানে সক্ষম নারী—যাদের বয়স ১৫ থকে ৪৯ বছর, তাদের জন্য ধনুষ্টংকার ও রুবেলার বিরুদ্ধে টিটি ও এমআর টিকা দেয়া হয়। তবে টিটেনাসের ৫টি টিকার ডোজ সম্পন্ন থাকলে আর গর্ভাবস্থায় এই টিকা নেয়ার প্রয়োজন হয় না। আর কেউ যদি কোনো টিকা না নিয়ে থাকেন, সেক্ষেত্রে গর্ভাবস্থায় ৫ মাসের পর ১ মাসের ব্যবধানে পর পর দুটি টিটি টিকা দিয়ে নিতে হবে। আর যদি পূর্বে দুই ডোজ টিকা নেয়া থাকে তাহলে প্রতি গর্ভাবস্থায় মাত্র একটি বুষ্টার ডোজ (booster dose) নিতে হবে। গর্ভবতী মাকে দেয়া এই টিকা মা ও বাচ্চা উভয়েরই ধনুষ্টংকার রোগের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তুলে। প্রসবকালে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ,অপরিষ্কার ছুরি, পরিচ্ছন্নতায় অসতর্কতা এবং , ব্লেড বা কাঁচি ব্যবহার করলে (বাচ্চার নাভী কাটার সময়) অথবা নাভীর গোড়ায় নোংরা কিছু লাগিয়ে দিলে নবজাতকের ধনুষ্টংকার রোগ হয়।
টিটি টিকা সূর্যের হাসি চিহ্নিত ক্লিনিক,বড় হাসপাতাল, মেরিস্টোপস ক্লিনিক, মেডিকেল কলেজ , সরকারি হাসপাতাল, ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে দেয়া হয়।
গর্ভবতী হলে বা আপনার পরিবার ও বন্ধুদের কেউ গর্ভবতী হলে এই টিকাগুলো সময়মতো যাতে নেয়া হয় সেদিকে খেয়াল রাখুন।
এর ফলে আগত শিশু ও মা উভয়েই নিরাপদ থাকে ।